ধারাবাহিক উপন্যাসঃ নাইয়র (চতুর্দশ পর্ব)
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ১১:৩২:৫৯ সকাল
আমাদের দেশের একটা প্রচলিত নিয়ম হল, সব কিছু শেষ হয়ে গেলেই সবাই আসে। সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ঘটে যাবার পরেই পুলিশের অভ্যুদয় ঘটে। শ্রীরামকাঠী গ্রামের এই ঘৃণ্য সহিংস ঘটনাটি ঘটে যাবার পরে, লোকাল থানা পুলিশের আগমন। জেলা শহর থেকে সরকারি দলের নেতারা এলেন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে। সবাই চোখেমুখে বেদনার ছাপ ফুটিয়ে তুলতে যারপরনাই চেষ্টা কম করলেন না। আর সাথের আলোকচিত্রীরা মুহুর্মুহু ফ্ল্যাশ লাইটের আলোয় বিমুঢ় নিস্তব্ধ হিন্দু লোকগুলোকে বগলদাবা করা নেতাদের ছবি তুলতেই ব্যস্ত!
বাহ! কত সুন্দর দৃশ্য! আগামিকালের পত্রিকার হেডলাইন হবে এই যুগলবন্দী ছবি। সাম্প্রদায়িক দলের হাতে এদেশের সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে আরো এক দফা রাজনীতির ময়দান উত্তপ্ত হবে। লেটনাইট টক-শো গুলোতে বক্তাদের কথার ফুলঝুরি ছুটতে থাকবে। মুখ দিয়ে ফেনাও বের হয়ে যেতে পারে। কিন্তু তাতে করে এই যে ক্ষতিগ্রস্ত সনাতন ধর্মের মানুষদের কি লাভ হবে? হয়তো সরকার ওদেরকে ক্ষতিপুরণ হিসাবে থোক কিছু 'দান' করে যাবে, কিংবা নতুন ঘর বানিয়ে দিবে। তবে নিজেদের মনের ভিতরের যে অপুরণীয় ক্ষতি সাধিত হল, সেটার পুরণ হবে কিসের দ্বারা? সবাই একসাথে মিলে মিশে থাকার সম্প্রীতির যে বাহুডোর ক্ষতিগ্রস্ত হলো, তা কি আদৌ পুরণ হবার?
মোতাহারের ইউনিয়ন পরিষদ অফিসে দলীয় নেতারা রুদ্ধদ্বার সভায় মিলিত হয়েছেন। জেলা সভাপতি এবং বর্তমান এমপির সাথে দলের জেলা সাধারণ সম্পাদকও রয়েছেন। মালেক শিকদার এবং মোতাহার তাদেরকে নিয়ে ঘটনার আনুপর্বিক বর্ণনা দিচ্ছে। একপর্যায়ে মালেক শিকদার যখন এই ঘটনার দায় সাম্প্রদায়িক দলটির ওপরে চাপানোর কথা বলা শুরু করে, মোতাহার তাকে থামিয়ে দেয়। সে মাননীয় সংসদ সদস্যকে উদ্দেশ্য করে বলে, ' এই ঘটনাটি একটি পুর্ব-পরিকল্পিত এবং এর সাথে আমাদের দলের কিছু নেতাও জড়িত। বিশেষ করে উনি'- এ কথা বলে মোতাহার মালেক শিকদারের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে। মালেক শিকদার চীৎকার করে কিছু বলতে চাইতেই এমপি ওনাকে থামিয়ে দেয়। মোতাহারকে উদ্দেশ্য করে বলে, ' তোমার কাছে এর কি প্রমাণ আছে?' একটু হাসে মোতাহার। বলে, ' প্রমাণ? ঘটনার দু'দিন আগে উনি বাইরের ছেলেদেরকে সাথে নিয়ে এলাকায় মিটিং করেছেন। সেই ছেলেদেরকে ঘটনার দিনে দেখা গেছে। আর কি প্রমাণ প্রয়োজন?'
দলের জেলা পর্যায়ের সাধারণ সম্পাদক এবারে মুখ খোলেন, ' দেখ এর দ্বারা কোনো কিছুই প্রমাণ হয় না। মালেক সাহেব দলীয় কাজে মিটিং করতেই পারেন...'। ' কিন্তু তাই বলে মিটিং একটা জঙ্গলের ভিতরে হবে?'- মোতাহার তীব্র স্বরে জানায়। ' আমরা সরকারি দল, আমাদের তো নকশালদের মতো গোপন সভার প্রয়োজন নেই।'
এবারে সাধারণ সম্পাদক বলেন, ' শোনো ছেলে, তোমাকে সবার আগে নিজ দলের কথা ভাবতে হবে। ভুলে যেও না তুমি এই দলের ব্যানারেই আজকে চেয়ারম্যান হয়েছ।' মোতাহার অনুচ্চ স্বরে উত্তর দেয়, ' মাফ করবেন, আমার কাছে দলের আগে আমার নিজের গ্রাম। আর আপনার এই ভুল ধারণাও ভেঙ্গে দিচ্ছি যে, আমি দলীয় ব্যানারে কিন্তু নির্বাচন করি নাই। এই নির্বাচন দলীয় ব্যানারে হয় না। আর আপনাদের সমর্থন কিন্তু মালেক শিকদারের প্রতি ছিল, এটা ভুলে গেলে আপনাকে আবারো স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি।' সাধারণ সম্পাদক খুব উত্তেজিত হয়ে উঠেন, ' তুমি তোমার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছ মোতাহার! ভুলে যাচ্ছ, দল ছাড়া তুমি কিছুই না।' তুড়ি মেরে তিনি কথাগুলো বললেন।
মোতাহার কিছুটা উত্তেজিত হয়। সে বলে, ' এই ঘটনা যারাই ঘ্টাক না কেন, তাদেরকে খুঁজে বের করা হবে। অনেককেই লোকজন দেখেছে, চিনে রেখেছে। এরা কোন দলের সমর্থন করে তাও সবাই জানবে। সেটা কীভাবে ঢাকবেন? আর কেন এই ঘটনা ঘটানো হয়েছে, সেটাও সবাই জানবে।'
এমপি সাহেব মোতাহারকে স্নেহ করতেন। তিনি মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, ' তুমি কি আমাদেরকে থ্রেট দিচ্ছ?' মোতাহার তাঁকে জানায়, ' আমি শুধু নির্জলা সত্য কথাটা আপনাদের সামনে তুলে ধরলাম।'
এমপি ওর কথার জবাবে ঠান্ডা স্বরে জানালো,' দেখ, রাজনীতিতে অনেক সময় অপ্রিয় অনেক কিছুই করতে হয় আমাদেরকে। সব সময় কিন্তু সত্যের পক্ষে থাকাটা ভালো হয়ও না। তাই তুমি যা করবে নিজ দায়িত্বে ভেবে চিন্তেই করবে আশা করি।' মোতাহার দৃঢ় স্বরে তাঁকে জানায়, 'আমি সত্যের পক্ষেই থাকবো।'
ঝড়ে বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে ঠিক করে, আবার নতুন করে শুরু করে। কিন্তু আমাদের দেশের এই সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে কেন জানি নিজেদের দুর্ভাগ্যও চলে আসে পায়ে পায়ে। তবে বর্তমান সরকারের সাথে এই ধর্মাবলম্বীদের কেমন যেন এক অলিখিত সম্পর্ক রয়েছে। তাই এদের আমলে এরকম ভয়াবহ ঘটনা ঘটে যাওয়া, কেমন যেন একটু অবাকই লাগে।
কয়েকটি বিষন্ন দিন অতিবাহিত হয় রাতের নিঃসঙ্গতায়। হিন্দু পরিবারগুলোর বোবা কান্নায় শ্রীরামকাঠী গ্রামের আকাশ ভারী হয়ে থাকে গুমোট বাতাসে। মোতাহার, পারুল এবং মুজিবর লজ্জায় ওদের দিকে তাকাতে পারে না। সন্তোষ মন্ডলকে উপজেলা থেকে জেলা সদরে উন্নত চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত তার অবস্থা উন্নতির দিকে।
একটা ব্যাপারে হিন্দু পরিবারগুলোর প্রধানেরা বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত নিলো। তাঁরা সরকারি 'দানের' টাকা ঘৃনাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। এই পরিবারগুলো আর্থিকভাবে এতোটা অসচ্ছল নয় যে, তাঁদের পুনর্বাসন এর জন্য কারো দানের প্রয়োজন হবে। তবে সরকারি প্রতিনিধির কাছে তাঁদের একটাই দাবী ছিল, ঘটনার সাথে জড়িতদেরকে চিহ্নিত করে শাস্তি দেয়া হোক। যেটা আসলেই এই বিচিত্র দেশে একেবারে অসম্ভব। এখানে চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা ক্ষমতাসিনদের আশ্রয়ে থাকে... পুলিশ প্রশাসন তাদেরকে খুঁজেই পায় না! এই গ্রামের ঘটনায় জড়িতরাও হয়তো এভাবে ঘুরে বেড়াবে, কিন্তু চিনেও তাদেরকে ধরার সাধ্য কারো হবে না।
মোতাহার মনের থেকে হিন্দু পরিবারের এই সিদ্ধান্তকে শ্রদ্ধা জানায়। আর থেকে থেকে নিজের ব্যর্থতার কথা ভেবে কষ্ট পায়...
একই ভাবে কষ্ট পায় মুজিবর এবং পারুল। রাজনীতির নোংরা খেলায় তাঁরা যে কতটা অসহায়, এবার সেটা নিজেরা টের পায়। নিজের অক্ষমতায় পারুলের সামনে অদম্য কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে মুজিবর। পারুল ওকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করে না। শুধু ওর হাত ধরে বসে থাকে নীরবে। এভাবে মনের সকল অক্ষমতা পানি হয়ে বয়ে যাক। নতুন দিনের আশায় উজ্জীবিত হয়ে উঠুক হৃদয়। সেখানে থাকবেনা কোনো পংকিলতা... কুটিল মনের বিষবাষ্পে জর্জরিত ওদের গ্রামের আকাশ একদিন মুক্ত হবেই।
... ... ...
বাজারে কোথায় যেন সাবিনা ইয়াসমিনের গান বাজছে, ' একটি বাংলাদেশ, তুমি জাগ্রত জনতার, সারা বিশ্বের বিস্ময়, তুমি আমার অহংকার'। মুজিবর আউয়াল খাঁর দোকানে বসা। কোনো কারণ ছাড়াই ওর চোখে জল আসার উপক্রম হল। পাশের লোকজনের সামনে লজ্জা পেতে না হয়, তাই উঠে চলে গেলো। এসেছিল 'গোলাঘর প্রোজেক্টের' জন্য বাকি কৃষকদের সাথে কথা বলতে। কিন্তু লিস্টের বাকী এরা সবাই হিন্দু। এই মুহুর্তে তাঁদের সাথে কথা বলতেও কেমন যেন বাধো বাধো ঠেকছে ওর কাছে। উদ্দেশ্যবিহীন ঘোরাফিরায় কাটালো কিছুটা সময়। মোতাহারও বাজারে নেই। সে পিরোজপুর গেছে সন্তোষ মন্ডলকে দেখতে। লঞ্চ ঘাটের দিকে চললো। ওখানে সুভাসের টেইলার্সে কিছু কাজ আছে। সেটাই সেরে আসবে কিনা একবার ভাবে। তারপর রওয়ানা সেদিকেই হয়।
পারুল নিজের বাড়িতে মায়ের সাথে ঘরোয়া কাজে সাহায্য করছে। মা-মেয়ে নীরবে কাজ করে যাচ্ছে। একপর্যায়ে মা মেয়েকে সরাসরি বিয়ের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেন। পারুল কিছু না বলে একমনে কাজ করে যায়। ভাবে কি বলবে তাঁকে। মাও কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবারো জিজ্ঞেস করেন। এবারে কিছু না বললেই নয়। তাই সে বলে, বিয়ে নিয়ে সে এখনো তেমন ভাবে কিছু ভাবেনি। মা এবার মুজিবরের কথা সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রয় পারুল কিছুক্ষণ।এরপর হাতের কাজ ফেলে আঁচলে হাত মুছে মাকে টেনে এনে খাটের পাশে বসায়। নিজেও পাশে বসে। মায়ের ঘাড়ে দুই হাত রেখে বলে, ' মা, বিয়ে করলে ওকেই করবো। কিন্তু গ্রামের ভালোর জন্য আমাদের আরো অনেক কাজ পড়ে আছে। আগে সেগুলো সেরে নেই। সময় তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না।' মা কিছুটা নারাজ হন। বলেন, 'দেখ, সময় না পালাক, মুজিবরের মা-বাপ মেয়ে দেখছে। শেষে এমন না হয় যে...' । মা কথা শেষ না করে থেমে যান। পারুল হাসে। বলে, ' তুমি খামোখা চিন্তা করছ মা। সব ঠিক হয়ে যাবে দেখ।' মা একা একা বলতে থাকেন, ' চিন্তা কেন করি, সে তুই এখন বুঝবি না মা।' দুজনে আবার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
সন্তোষ মন্ডলের কাছ থেকে এই মাত্র ফিরে এলো মোতাহার। মটর সাইকেল স্ট্যান্ডে রেখে ইউনিয়ন পরিষদ অফিসে ঢুকলো। লোকটার অবস্থা ভালোর দিকে। তবে সেদিনের ঘটনায় এখনো কেমন এক বিহ্বল অবস্থায় রয়েছেন। একই ধরণের ঘটনা তার সাথে তো কয়েকবারই হল। মোতাহার যতক্ষণ ছিল, তিনি ওর হাত ধরে নীরব কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছিলেন। দুজন ভিন্ন ধর্মের মানুষ হৃদয়ের গোপন তারে তাঁদের ভাব বিনিময় করে চলেছিলো যেন। কি-ই বা বলার ছিল মোতাহারের। তবে বিদায় নেবার বেলায় মোতাহারের দিকে তাকিয়ে সন্তোষ মন্ডল বললেন, ' বাবা, খেয়াল রাখিস'। শুধু এইটুকু কথা। কিন্তু এর ভিতরে কত যে না বলা কথা ছিল! সারাটা পথ হোন্ডা চালাতে চালাতে মোতাহার ভেবেছে শুধু। সন্তোষ মণ্ডলের এই শেষ কথাটি কি শুধুই মোতাহারের উদ্দেশ্যে? নাকি একজন জনপ্রতিনিধি হিসাবে ওকে বলা? একজন সন্তোষ মন্ডল কি শুধুই একজন সন্তোষ মন্ডল? সে কি এ দেশের পুরো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করছে না? আর একজন মোতাহার কি এ দেশের রাজনৈতিক সিস্টেমের কনিষ্ঠ পদাধারী ক্ষুদ্রতম একক নয়? আসলে সন্তোষ মন্ডলের কথাটি এদেশের নিয়ন্ত্রণকারী সিস্টেমের সবার উদ্দেশ্যেই বলা। আর এ কাজটিই কিন্ত তাঁদের আসল কাজ। খেয়াল রাখা। সাধারণ জনগণের খেয়াল রাখার জন্যই তো তাদেরকে এই জনগনই ক্ষমতায় বসায়। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মোতাহার রুমের ভিতরে চলে যায়।
আরো সপ্তাহখানেক কেটে যায়। সন্তোষ মন্ডল বাড়িতে ফিরে এসেছে। অবশেষে গোলাঘর প্রোজেক্টের জন্য সকল কৃষক একমত হয়। মোতাহারের বাড়ির সামনের খালি যায়গাটিতে বিশাল এক ঘর বানানোর কাজ শুরু হয়েছে। সকলে মিলে নির্ধারিত পরিমাণে চাঁদা দিয়ে প্রোজেক্টের ব্যয় নির্বাহের কাজে এগিয়ে আসে।
সেদিন বিকেলে পুরোদমে কাজ চলছে। হাবিব মুন্সী কি কাজে যেন এদিকে এসেছিলেন। তখন সেখানে মোতাহার ছিল না। যারা কাজ তদারকি করছিলো তাঁদের কাছে এখানে কি হচ্ছে তিনি জানতে চাইলেন। মিস্ত্রীদের ভিতর থেকে একজন আসল কথা বলে ফেললো। ওর কাছ থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আরো কিছু কথা জেনে নিলেন হাবিব মুন্সী। তবে সেভাবে ঐ লোক তাঁকে কিছু জানাতে পারলো না। কিন্তু এর ভিতর থেকেই যা বোঝার বুঝে নিলেন ক্ষমতাধর এই কুটিল মানুষটি।
মোতাহারের মায়ের সাথে কাজ সেরে হাবিব মুন্সী যখন চলে যাচ্ছে, পথে মোতাহারের সাথে দেখা। কিন্তু চতুর লোকটি ওর কাছে এই বিশাল ঘর সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস করলো না। স্বাভাবিক কুশল বিনিময় হলো ওদের ভিতরে। তবে মোতাহারের কাছে এই কিছু না জিজ্ঞেস করাটা কেমন যেন লাগলো। চিন্তিত মনে মোতাহার ঘরের কাজ দেখতে থাকে। ভ্রুযুগল কুঁচকে রয়েছে। এতো আগে যদি হাবিব মুন্সী সব জেনে গিয়ে থাকে, তবে সমস্যার কথা। এটা প্রতিরোধে সে কি ব্যবস্থা নেয়, তা-ই দেখার বিষয়। ধুত্তুরি, যা হবার হবে, সময়ে দেখা যাবে বলে চিন্তার মোড় ঘোরায় মোতাহার। এখনো অনেক কাজ বাকি। সময় হাতে কম রয়েছে। নিজের অজান্তেই এক ভবিতব্যের কথাই কি আগাম ভেবে বসলো মোতাহার?
এদিকে নাজিরপুর থানা প্রশাসন উপর মহলের চাপে শ্রীরামকাঠী গ্রামের সনাতন ধর্মের পরিবারগুলোর উপর সংঘটিত সন্ত্রাসী কাজে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। প্রথমে তাঁরা এই কাজে এলাকার কারা জড়িত ছিল সেটা তলিয়ে দেখতে চাইলো। সবসময়ই যা হয় আর কি। ঘটনার মূল হোতাদের আড়ালে রেখে চুনোপুটিদের ধরে সামনে নিয়ে আসা হয়। এবারেও তার ব্যতিক্রম হলো না। মালেক শিকদার উপজেলা পর্যায়ে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী একজন নেতা। তার যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে এই থানায়। সে পেছন থেকে কলকাঠি নেড়ে এলাকার কিছু নিরীহ যুবকদের নামও দিয়ে দিলো। অবশ্য বলির বকরা হিসাবে জড়িত কয়েকজনকেও ধরিয়ে দিলো। সব কিছুর মূলে ছিল 'পলিটিক্স'। নোংরা রাজনীতির চালে কিছু যুবক অহেতুক হয়রানির শিকার হতে যাচ্ছে। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নির্দেশে এই অভিযুক্তদেরকে 'চালান' করে দেয়া হল জেলা সদরে।
মোতাহার সব কিছু যখন জানতে পারলো, তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। তারপরও সে থানায় গিয়ে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সাথে কথা বললো। আলোচনার এক পর্যায়ে মোতাহার জানতে চায়, এই নিরীহ যুবকদেরকে কিসের ভিত্তিতে গ্রেফতার করা হল। ওর কথার উত্তরে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জানায়, সেটা কাউকে জানানোর বিধান নেই। একমাত্র আদালতেই প্রমাণ সহ রিপোর্ট দেয়া হবে। তখন সেদিন মাননীয় এমপি সাহেবকে মোতাহার যা বলেছিল, ঐ কর্মকর্তাকেও একই কথা সে জানায়। এও বলে, আসল তথ্য অচিরেই বের হয়ে আসবে এবং আসল ঘটনা ধামাচাপা দেবার এই তদন্ত নিয়ে তাকেও আইনের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। আর কারা কারা ঘটনার সাথে জড়িত ছিল, সেটা অনেকের কাছে মোবাইল ক্যামেরায় ধারন করা রয়েছে। এ কথা শুনে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা একটু দমে যায়। তবে তার চেহারায় সেটা প্রকাশ পায় না। সে নিশ্চুপ থাকে।
সেই রাতে হাবিব মুন্সীর নেতৃত্বে নাজিরপুর থানা কম্পাউন্ডে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বাসায় এক গোপন সভা বসে। দুষ্ট চক্রের প্রধান দুই সদস্যকে সাথে নিয়ে হাবিব মুন্সী রয়েছেন। আর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। হাবিব মুন্সীকে প্রথমে মোতাহারের ব্যাপারে সব জানানো হয়। মালেক শিকদার জানায় মোতাহার কীভাবে সেদিন জেলা সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকের সামনে আচরণ করেছিল। থানার কর্মকর্তাও আজকের কথাবার্তা তার সামনে উপস্থাপন করে। হাবিব মুন্সী ভাবতে থাকেন। মনে হচ্ছে এবার সব কিছু মিলিয়ে তাকে একটি কঠিন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হবে। মালেক শিকদারও অনেক আগে থেকেই একটি চিন্তা তার মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে। কিন্তু সেই পথে হাঁটার মত পরিস্থিতি তখনো তৈরী হয়নি বিধায় তিনি কোনো সিদ্ধান্ত নেন নাই। কিন্তু মনের কথা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সামনে কিছুই প্রকাশ করলেন না। শুধু বললেন, ' মোতাহার আমার ভাতিজা। ওকে সামলানোর ভার আমার উপর ছেড়ে দিন ওসি সাহেব। আপনি আপনার কাজ করে যান। এদিকটা আমি দেখছি।' বিমুঢ় মালেক শিকদারকে সাথে নিয়ে থানার ওসির কম্পাউন্ড থেকে হাবিব মুন্সী বের হয়ে আসেন। একটা রিক্সা নিয়ে শ্রীরামকাঠী বাজারের লঞ্চ ঘাটের দিকে রওয়ানা হন।
লঞ্চ ঘাটের পাশের তাঁদের সেই অস্থায়ী ঘাঁটির সামনে রিক্সা দুটি থামে। ভাড়া মিটিয়ে কোব্বাত এবং মালেক শিকদারকে নিয়ে হাবিব মুন্সী দোকানের ভিতরে চলে যান। দোকানের ভিতরের ছেলেটিকে চলে যেতে বলেন। সে চলে গেলে দোকানের সাটার টেনে দিতে বলেন কোব্বাত মিয়াকে।
মালেক শিকদার থানার ওসির সামনে তার ঐ কথাবার্তার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করবে ভাবছিল মনে মনে। কিন্তু হাবিব মুন্সী তার বলার আগেই এই প্রসঙ্গ তোলেন। বলেন, 'শোনো শিকদার। মনের কথা একান্ত নিজের ছাড়া কাউকে কখনো জানাবে না। বিশেষ করে পুলিশের লোকের সামনে তো নয়ই। আজ সে আমাদের জন্য ভালো, কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে সেটা খারাপ হতে কতক্ষণ?'
মালেক শিকদারের অবাক মুখের দিকে তাকিয়ে একটু হাসেন হাবিব মুন্সী। বলেন, ' এতো দিন ওরা যা করেছে, তাতে আমাদের তেমন কোনো ক্ষতি হয় নাই। বিশেষ করে আমাদের তিনজনের। কিন্তু এই গোলাঘর বানানোর দ্বারা ওরা আমাদেরকে একেবারে শেষ করে দিতে চাইছে। যদিও ওরা জানে না ফড়িয়াদের পেছনে আমরা রয়েছি।'
কোব্বাত মিয়া এবং মালেক শিকদার তার কথায় মাথা নেড়ে সায় দেয়। হাবিব মুন্সী বলে যেতে থাকেন, ' আর চিন্তা ভাবনার প্রয়োজন নেই শিকদার। তুমি যা চেয়েছিলে, সেটাই কর। সব কিছুর ব্যবস্থা কর। আর ব্যাপারটা যেন রাজনৈতিক রূপ পায় সেটাও দেখবে। তোমাকে কি আমার আরো খোলাসা করে বলে দিতে হবে?'
মালেক শিকদার বলে, ' আপনি মুরব্বি মানুষ। দিলে ভালোই হয়।' হাবিব মুন্সী ওদের দুজনকে আরো কাছে ডাকেন। তিনটি কুটিল মাথা এক হয়। দশ মিনিট ধরে হাবিব মুন্সী একটানা কথা বলে যেতে থাকেন। বাকী দুজন মগ্ন হয়ে তার কথা শোনে। একটা ভয়ংকর পরিকল্পনা রাতের আঁধারে একটি মুদী দোকানের বন্ধ কক্ষে বের হয়েই তিনটি কুটিল ব্রেইনে ঢুকে যায়।
হাবিব মুন্সী নিজের বাড়ির দিকে যখন রওয়ানা হন, আকাশে লক্ষ তারার মেলা। মৃদুমন্দ বাতাসে তার সাদা দাঁড়ি উড়ছে। আজ মনটাও তার অনেক ভালো লাগছে। অনেক দিন পরে বুকের ভিতর থেকে যেন একটি বোঝা দূর হলো। আকাশের দিকে তাকান। সপ্তর্ষি মন্ডলের দিকে চোখ পড়তেই হঠাৎ কেন জানি অনেক আগের কিছু কথা মনে পড়ে যায়। মোতাহার তখন বেশ ছোট। এই ভাতিজাটিকে অনেক আদর করতেন। তার কোলে কোলেই সে থাকত। রাতে ঘরের দাওয়ায় বসে হাবিব কাক্কুর কাছ থেকে গল্প না শুনে বালক মোতাহারের ঘুমই হতো না। গল্প শেষে আকাশের তারাদের চিনিয়ে দিতেন তিনি। সপ্তর্ষি মণ্ডলকে গ্রামের মানুষ বলে, 'সাত জাল'। একটা জালের মতো আকৃতি নিয়ে সাতটি তারার অবস্থান। মোতাহারকে এক একটি তারা দেখাতেন। তবে গুনবার সময় একটি তারা প্রতিবারই বাদ পরে যেতো। এটি ছিল অস্পষ্ট। এই নিয়ে চাচা-ভাতিজার ভিতরে কত যে মৃদু খুনসুটি চলতো!
হঠাৎ পথের মাঝে থেমে যান হাবিব মুন্সী। নিজের ভিতরে এক ভাবাবেগের প্রবলতায় অস্থির হয়ে উঠেন। কাজটি কি ঠিক করছেন তিনি? স্নেহের ভাতিজার বিরুদ্ধে কিছুক্ষণ আগেই চরম একটি সিদ্ধান্ত নেবার হুকুম দিয়ে এলেন। কিন্তু বিগত কয়েক মাসের মোতাহারের কর্মকান্ডের কথা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই কোথা থেকে যেন রাজ্যের কঠোরতা এসে ভীড় করলো হৃদয়ের মাঝে। কোমল আবেগকে হটিয়ে সেগুলো হৃদয়কে আবারো পাষাণে পরিণত করে দিলো। তিনি ভাবেন, নিজের অস্তিত্বের প্রশ্ন এখন। তিনি একা হলেও কথা ছিল না। তবে তিনি যাদের প্রতিনিধিত্ব করছেন, মোতাহার সেই শ্রেনীর বিপক্ষেই রয়েছে। এখন হয় মোতাহার কিংবা তাঁদের এই শ্রেনী- দুপক্ষের যে কোনো একটিকে ধবংস হতেই হবে। ভালো আর মন্দ কখনো এক সাথে থাকতে পারেনা।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকেন। আকাশের দিকে তাকিয়ে অনেক মেঘের আনাগোনা দেখেন। এইমাত্র তারারা সব আঁধারে লুকিয়েছে। একটা বিষণ্ণ অন্ধকার শ্রীরামকাঠী গ্রামটিকে ঢেকে দিয়েছে এই মুহুর্তে। হাবিব মুন্সীর বুক থেকে ' আল্লাহ তুমি মাফ করনেওয়ালা' কথাটি বের হয়ে আসে। মাথা নিচু করে খালের পারের রাস্তা থেকে বাড়ির সরু রাস্তায় উঠে আসেন তিনি।
(আগামী পর্বে সমাপ্য)
পাঠকদের প্রতিঃ
ধারাবাহিকভাবে 'নাইয়র' এর ১৪টি পর্ব শেষ হল। ১৫ পর্বে শেষ করে দিতে চেয়েছিলাম। তাই আর একটি পর্ব বাকী রইলো। এখন যারা নিয়মিত এই গল্পটি পড়েছেন, এ নিয়ে মন্তব্য করেছেন- তাঁদের কাছে কিছু জিজ্ঞাস্য রয়েছে আমার। আমাদের দেশের বাস্তবতায় কীভাবে এটির শেষ পর্ব শেষ করলে ভালো হয়? শুভ বুদ্ধির পক্ষাবলম্বনকারী তিনজন কি অশুভ চক্রের কাছে হেরে যাবে? মোতাহারের কি করুণ পরিণতি হবে? পারুলেরা যে সকল প্রোজেক্ট শুরু করেছিল, সেগুলো কি অচিরেই মুখ থুবরে পড়ে যাবে? আমি আমার মত করে কিছু একটা চিন্তা করে রেখেছি। এখন আপনাদের চিন্তা-ভাবনাগুলো জানলে খুশী হতাম। ধন্যবাদ।
বিষয়: সাহিত্য
৮৭৫ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
সুন্দর বলেছেন।
অনেক অনেক শুভেচ্ছা আপনার জন্য।
মন্তব্য করতে লগইন করুন